আপাতবিরোধী বা স্ববিরোধী কোন ঘটনাকে প্যারাডক্স বলে। প্যারাডক্স শব্দের আভিধানিক অর্থ কূট, সম্ভাব্যতা-বিরোধী ব্যক্তি বা বস্তু। প্যারাডক্স এমন কোনো বাক্য, উক্তি বা ঘটনা যা থেকে নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। কোন বাক্য বা উক্তির ক্ষেত্রে হয় সেটি সত্য হবে না হয় মিথ্যা হবে। কিন্তু প্যারাডক্স এর ক্ষেত্রে এটি সত্য বা মিথ্যা কোনোটাই হয় না।
ধারণা করা হয় প্যারাডক্সের সূচনা ঘটেছে চীনে। একসময় চীনে এক লোক ঢাল ও বল্লম বিক্রি করতো। একবার সেই বল্লম বিক্রেতা দাবি করলো আমার কাছে এমন এক ঢাল আছে যা, যেকোনো কিছুকে প্রতিরোধ করতে পারে। আবার সে দাবি করলো আমার কাছে এমন এক বল্লম আছে যা, যেকোনো কিছুকে ভেদ করতে পারবে। বিক্রেতার এই কথা শুনে এক চতুর ক্রেতা বলল, "আমি যদি এই বল্লম দিয়ে এই ঢালে আঘাত করি তাহলে কী হবে?" মুলত এই ঘটনা থেকেই প্যারাডক্স বা স্ববিরোধী ঘটনার উৎপত্তি। ইতিহাসে এমন অনেক বিখ্যাত প্যারাডক্স রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু প্যারাডক্স এতই জটিল যে আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দিবে। এরকম কিছু প্যারাডক্স এখানে দেওয়া হলো-
সরাইটিস প্যারাডক্স
মনেকরি একটি পাত্রে একটি চালের দানা আছে। আমরা এটাকে চালের স্তুপ বলবো না কেননা এখানে কেবলমাত্র একটি চালের দানা-ই রয়েছে। এখন আমরা যদি এর সাথে আরো একটা চালের দানা যোগ করি তবুও এটাকে চালের স্তুপ বলা যাবে না। কারণ মাত্র একটা দানার পার্থক্য ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তাহলে যদি n সংখ্যক চালের দানাকে একত্র করলে যদি সেটা চালের স্তুপ না হয় তাহলে এর সাথে একটা চালের দানা যোগ করে n+1 করা হলে সেটাও চালের স্তুপ হবে না। আবার, যদি n সংখ্যক চালের দানা বিশিষ্ট একটি চালের স্তুপ থেকে একটি চালের দানা সরিয়ে n-1 করা হলে সেটি চালের স্তুপই থাকবে। এরকম করে একটা একটা করে চালের দানা কমাতে কমাতে শেষে যদি একটা চালের দানা থাকে তাহলে সেটাও চালের স্তুপই হবে।
আগন্তুক ও নগররক্ষী প্যারাডক্স
আগন্তুক ও নগররক্ষী প্যারাডক্স টা এরকম- এক শহরে এক দাড় রক্ষী আছে। কেউ শহরে প্রবেশ করতে গেলে সে তাকে একটা প্রশ্ন করে, "আপনি এই শহরে কেন এসেছেন?" যদি তার উত্তর সত্য হয় তাহলে তাকে ফাঁসি না দিয়ে শহরে ঢুকতে দেওয়া হয়। অন্যথায় তাকে ফাসি দেওয়া হয়। একবার একজন লোক শহরে প্রবেশ করতে চাইলে নগররক্ষী তাকে জিজ্ঞেস করলো সে কী কারণে শহরে এসেছে। সে উত্তর দিলো, "আমি ফাসিতে ঝুলতে এসেছি।" এই উত্তর শুনে নগরক্ষীর কী করা উচিত। আগন্তুককে কি ফাঁসি দেওয়া হবে? নাকি না? যদি তাকে ফাঁসি দেওয়া তাহলে তাহলে লোকটির কথা সত্য হয়ে যাবে। আর যদি ফাঁসি না দেওয়া হয় তাহলে লোকটির কথা মিথ্যা হয়ে যাবে। আর নিয়মানুযায়ী মিথ্যা উত্তরদাতাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।
গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স
গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সটি টাইম ট্রাভেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। টাইম ট্রাভেল বা সময় পরিভ্রমণ যদি সম্ভব হয়, তাহলে এক জটিলতার সৃষ্টি হবে যাকে নিয়েই এই গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স তৈরি হয়েছে।
কেউ যদি টাইম মেশিনে করে অতীতে গিয়ে তার দাদার ছোটবেলা তার বাবার জন্ম হওয়ার আগেই তার দাদাকে হত্যা করে তাহলে তার পিতার জন্ম হবে না। তার পিতার জন্ম না হলে সেও জন্মগ্রহণ করবে না। কিংবা সে যদি জন্মগ্রহণ না-ই করে তাহলে অতীতে গিয়ে তার দাদাকে কে হত্যা করলো।
ডিকোটোমি প্যারাডক্স
ডিকোটামি প্যারাডক্স এর উদ্ভাবক দার্শনিক জেনো। ধরা যাক, কোনো ব্যক্তি একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তিনি পথের অর্ধেক (১/২) অংশ অতিক্রম করলেন। তারপর পথের বাঁকি অংশের অর্ধেক অর্থাৎ পুরো পথের চার ভাগের এক ভাগ (১/৪) অংশ অতিক্রম করলেন। এভাবে তিনি প্রতিবারই বাঁকি পথের অর্ধেক করে অতিক্রম করতে লাগলেন। তাহলে তিনি যথাক্রমে পুরো পথের ১/২, ১/৪, ১/৮, ১/১৬ অংশ এভাবে যাচ্ছেন। ব্যাপারটি এমন দাড়ালো যে, তিনি কখনো সম্পূর্ণ পথ অতিক্রম করে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন না!
মিথ্যাবাদী প্যারাডক্স
এপিমেনাইডেস নামের একজন দার্শনিকের একটি উক্তির ওপর ভিত্তি করে মিথ্যাবাদী প্যারাডক্সটির উৎপত্তি ঘটেছে। তিনি বলেছিলেন, '' ক্রিটের সকল নাগরিক মিথ্যাবাদী '' তার এই কথা যদি সত্য হয় তাহলে তিনি নিজেও মিথ্যাবাদী কেননা তিনিও ক্রিটের নাগরিক। আবার তার কথা যদি মিথ্যা হয় তাহলে ক্রিটের সকল নাগরিক মিথ্যাবাদী নয়। তাহলে তিনিও মিথ্যাবাদী নন। কারণ তিনিও ক্রিটের বাসিন্দা। কিন্তু তিনি যদি সত্যবাদী হন তাহলে তার কথাটা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ তিনি আবার মিথ্যাবাদী হয়ে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ-না প্যারাডক্স
কিছু ব্যতিক্রমী প্রশ্ন রয়েছে যেসব প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না' দিয়ে দিলে প্যারাডক্স তৈরি হয়। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ''আপনি কি এখনো ঘুষ খান?''
তিনি যদি ঘুষ না খেয়ে থাকেন তাহলে, তিনি অবশ্যই 'না' বলবেন। তাহলে ব্যাপারটা এমন হয়ে যাবে যে, তিনি আগে ঘুষ খেতেন কিন্তু এখন খান না!
বুরিডানের গাধা
বুরিডান নামের এক ব্যক্তি তার এক ক্ষুদার্থ গাধাকে এক জায়গায় নিয়ে গেল যেখানে তার দুইপাশে সমান দুরত্বে দুটি খড়ের স্তুপ রাখা আছে। পরিমা্ রূপ, গন্ধের দিক থেকে একই মনে হচ্ছে। গাধাটি দুটি স্তুপের মধ্য থেকে কোনটি থেকে খাবে তা বুঝতে পারবে না। অবশেষে, ভাবতে ভাবতে না খেয়ে মারা যাবে!
বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স
বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্সটি টাইম ট্রাভেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। টাইম ট্রাভেল বা সময় পরিভ্রমণ যদি সম্ভব হয়, তাহলে এক জটিলতার সৃষ্টি হবে যাকে নিয়েই এই বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স তৈরি হয়েছে।
কেউ একজন কোনো বইয়ের দোকান থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ''গীতাঞ্জলী'' বইটির একটি কপি কিনলেন এবং টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিলেন। তখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ''গীতাঞ্জলী'' রচনা করেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটি পাওয়ার পর, তা নিজের নামে প্রকাশ করে দিলেন। এভাবেই চলতে থাকলো, সবাই জানল, 'গীতাঞ্জলী' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছে। কিন্ত আসলে তো তিনি সেটা লেখেননি। তাকে সেটা দেওয়া হয়েছে। তাহলে বইটা কে লিখেছে?
হ্যাংম্যান প্যারাডক্স
একজন ফাঁসির আসামিকে বলা হলো, সোমবার থেকে শুক্রবারের মধ্যে যেকোন এক দিন তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। তবে ঠিক কোনদিন হবে তা তাকে জানানো হবে না। কয়েদি চিন্তা করে দেখলেন তাকে শুক্রবারে ফাঁসি দেওয়া যাবে না, কারণ তিনি যদি বৃহস্পতিবারে বেঁচে যান, তাহলে জেনে যাবেন যে তাকে শুক্রবারে ফাঁসি দেওয়া হবে। কিন্তু বলা হয়েছে তিনি তার ফাঁসির দিনটি জানবেন না। আবার তাকে বৃহস্পতিবারেও ফাঁসি দেওয়া সম্ভব নয়, কেননা তিনি ইতিমধ্যে জেনে গেছেন যে, শুক্রবারে তার ফাঁসি হবে না। তাহলে বুধবারেই তিনি বুঝে যাবেন যে বৃহস্পতিবারেই তার ফাঁসি হবে। এভাবে একই নিয়মে তিনি দেখতে পেলেন, সোম থেকে শুক্র কোন দিনই তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো সম্ভব নয়।
রেস্টুরেন্ট প্যারাডক্স
একটা রেস্টুরেন্ট এ কেউ যায়না কারণ সেখানে ভিড় থাকে। তাহলে ভিড়ের কারণে কেউই যদি না যায়, তাহলে ওই ভিড় ওখানে আসে কোত্থেকে?
টুইন প্যারাডক্স
টুইন প্যারাডক্স টি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
দুই জমজ ভাইয়ের মধ্যে একজন যদি স্পেসশিপে করে মহাকাশে আলোর বেগে ছুটতে থাকেন। আর অপরজন যদি পৃথিবীতেই থাকেন। তাহলে মহাকাশ থেকে যখন একজন ৩ বছর পর ফিরে আসবেন তখন তিনি তার সময়ের সাপেক্ষে ৩ বছর কাটাবেন। রওনা হওয়ার সময় যদি তার বয়স ১৮ বছর হয় ফিরে আসার সময় তার বয়স তিন বছর বেড়ে ২১ হলেও, ফিরে এসে দেখবেন তার ভাই পৃথিবীতে বৃদ্ধ হয়ে গেছে
কার্ড প্যারাডক্স
কোনো ব্যক্তির কাছে একটা কার্ড দেওয়া হলো যার, এক পাশে লেখা, '' অপর পাশে যা লেখা আছে সেটা সত্য।'' এটাকে 'ক' ধরা যাক। ঐ ব্যক্তি কার্ডটি উলটে অপর পাশে দেখলেন লেখা আছে, '' অপর পাশে লেখাটি মিথ্যা।'' এটাকে 'খ' ধরা যাক। এখন 'ক' লেখা যদি মিথ্যা হয় তাহলে 'খ' লেখাটি মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। কারণ 'ক' তে লেখা ছিল যে, অপর পাশে (খ) যা লেখা আছে সেটা সত্য। আবার 'খ' লেখাকে মিথ্যা ধরলে, 'ক' লেখা সত্য হয়ে যাচ্ছে। কারণ 'খ' অংশে লেখা ছিল যে, অপর পাশে (ক) লেখাটি মিথ্যা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন